রোজকার ফুল



রোজকার ফুল 

চরিত্র তালিকাঃ
১. খুকি (প্রধান চরিত্র, ফেরিওয়ালির মেয়ে)
২. সাবিনা বানু (খুকির মা, ফেরিওয়ালি)
৩. আবির (মোবাইলে কথা বলা পথচারি)
৪. সন্ধ্যা (আবিরের বউ)
৫. আক্কাস (ফুলের দোকানের কর্মচারি)
৬. আক্কসের বন্ধু – ২ জন (পাশের দোকানের কর্মচারি )
৭. মোজাম্মেল হোসেন (ফুলের দোকানের মালিক)
৮. মান্না (প্রথম টোকাই)
৯. বুলেট ( দ্বিতী টোকাই)
১০. অজ্ঞাতনামা পথচারী যুবক – ৬/৭ জন


কাহিনী বর্ণনাঃ  

ঢাকা শহরের কোন এক স্থানের কোন এক ব্যাস্ত দিনের সকাল বেলা। প্রতিদিনের মত গাড়ির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রাস্তার দুপাশ ধোরে মানুষের অবিরাম আসা যাওয়া। এমনি এক রাস্তার পাশে, ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তারের নিচে দাড়িয়ে স্ত্রী সন্ধ্যার সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে আবিরের। সাংসারিক তর্ক বিতর্ক। হটাৎ উপরের তারে বসে থাকা এক কাক আবিরের কাঁধে মল ত্যাগ করে। নতুন কাল শার্টের কাঁধে সাদা দাগ দেখে অত্তন্ত বিরক্ত আবির ফোনে কথা বলতে বলতেই পকেট থেকে রুমালটা বের করে কাঁধ মুছতে গেলে কিছু টাকা পড়ে যায়, যা আবির খেয়াল করেনাআবিরের পেছনে কিছুটা দূরে বসা অঙ্গরাগ ফেরিওয়ালি সাবিনা বানুর মেয়ে, খুকি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। সে তার মার পাশে বসে খেলছিল। টাকাগুলো দেখে সে দৌড়ে যায়। টাকাগুলো কুড়িয়ে মাথা তুলতেই আবির উধাও। চারিদিকে কোথাও আবিরকে দেখা যাচ্ছে নাহটাৎ বামদিকে ঠিক আবিরের মত শার্ট পরা একটা লোককে দেখে তার পিছ পিছ ছুটতে থাকে খুকি। কিছুদূর যাবার পর লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে রিকশা ডাক দিলে খুকি থমকে যায়। এদিক ওদিক দেখে আবার সামনে এগতে থাকে খুকি, আবিরের খোঁজে। আস্তে আস্তে সে অনেক বেশি দূরে চলে যাচ্ছে দেখে সাবিনা বকার স্বরে ডাক দেয় খুকিকে। কিন্তু খুকি খেয়াল করছেনা দেখে বিরক্ত আর চিন্তিত হয়ে তাকে বেশি দূর যেতে নিষেধ করে সাবিনা। মার কথা না শুনে খুকি সামনেই হাঁটতে থাকে। প্রতিদিনের পরিচিত রাস্তার দুপাশে নানা পরিচিত-অপরিচিত ফেরিওয়ালা আর খেলারুদের দেখতে দেখতে একটা ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। চমৎকার সব দেশি বিদেশি ফুল, একজন সুন্দরী ক্রেতা আর মালিক মোজাম্মেল সাহেবকে দেখতে দেখতে দোকানের কাঁচের দেয়ালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে খুকি। নোংরা জামা পড়া পথকলি বেশের খুকিকে দোকানের কাঁচে হাত দিতে দেখে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাশের দোকানের দুই কর্মচারির সাথে আড্ডারত আক্কাস গালি দিয়ে মারমুখি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। আক্কাস দোকানের দরজার কাছাকাছি আসতেই মোজাম্মেল সাহেব ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বেড়িয়ে এসে তাকে থামিয়ে খুকিকে জিজ্ঞেস করে সে কি করছে এখানে। নিশ্চুপ খুকির ফুলের দিকে অবাক চাহুনি আর হাতে কিছু টাকা দেখে মোজাম্মেল সাহেব জিজ্ঞেস করে সে ফুল কিনতে চায় কিনা। নির্বাক খুকির শীতল দৃষ্টিতে নিরুপায় মোজাম্মেল সাহেব দোকান থেকে কিছু গোলাপ নিয়ে খুকির হতে ধরিয়ে দিয়ে তার মুঠি থেকে টাকা গুলো নিতে চেষ্টা করেন। ফুল গুলো নির্বিকার ভাবে নিলেও টাকা সে হাত ছাড়া করতে চায়না, কারন তখনও সে আবিরকে খুচ্ছে। একরকম ঠান্ডা টানাটানির মধ্যে দিয়ে মোজাম্মেল সাহেব টাকাটা নিয়ে ভেতরে চলে যান। নিরুপায় খুকি নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন দোকানের দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে উল্টো ঘুরে তার মার দিকে হাটা দিতে শুরু করে। বেশ কিছুদূর আসার পর হটাৎ অপর দিক থেকে সে আবির কে আসতে দেখে ফুল ফেরত দিয়ে টাকাটা আনতে তৎপর হয়। কিন্তু ততক্ষনে সে অনেক দূর চলে এসেছে। আবিরও আবার মাঝে মাঝে ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এমন দোটানায় পরে সে আর কিছু চিন্তা না করে আবিরের দিকেই ছুটতে থাকে। এক পর্যায়ে কানে মোবাইল ধরা আবির আর খুকি মুখোমুখি হয়। হটাৎ খুকিকে সামনে দেখে আবিরো হৎচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বন্ধুর সাথে সকালের সাংসারিক বাকবিতন্ডার আলাপ করতে করতে খুকির হাতে ফুল গুলো দেখে তার বধোদয় হয় যে আজ তার বিবাহ বার্ষিকী। বন্ধুকে ফোনটা রাখতে বলে খুকির উল্লোষিত চেহারার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করতে থাকে ফুল গুলোর দাম কতঅপ্রস্তুত খুকি ফুলের দাম চাওয়া শুনে কিছুটা অবাক হয়ে না বধোক মাথা নাড়ে। আবির তার মাথা নাড়ার অর্থ না বুঝে কিছুটা বিরক্ত হয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে সে আবিরের হাত ধরে ফুল গুলো বারিয়ে দেয়। আবির কিছুটা বিব্রত হয়ে আরো কয়েকবার দাম জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর না পেয়ে হাশতে হাশতে খুকির টাকার প্রতি উদাশিনতাকে ঠাট্টা করে ফুল গুলো এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে পকেট থেকে টাকা বের করতে গেলে প্রথম বারের মতো লক্ষ্য করে যে খুচরা টাকা গুলো হারিয়ে গেছে। প্যান্টের দুই পকেট আর বুক পকেট হাতড়ে কোনো টাকা না পেয়ে নিরুপায় আবির মানিব্যাগ হাতড়ে কিছু টাকা বের করে খুকির হাতে এক রকম জোর করেই গুঁজে দেয়। আবার নিরব দৃষ্টিতে টাকা গুলো হাতে নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে খুকি। তাজা ফুলগুলো হাতে নিয়ে সন্ধ্যার সাথে খুদেবার্তা আদান প্রদান করতে করতে ভিড়ে মিলিয়ে যায় আবির। এ পর্যায়ে খুকির ক্ষিদের জ্বালাটা টাকার স্বদব্যাবহার করতে উৎসাহিত করে। টাকার মূল্যমান না জানা খুকি পাশের টং দোকানটা থেকে নির্বাক ভঙ্গিতেই একটা রুটি আর কলা কিনে খাওয়ার জন্য গালের কাছে নিতেই টোকাই মান্না ছোবল মেরে রুটি আর কলাটা নিয়ে দৌড় দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু রাস্তার কয়েকজন পথচারি যুবক পুরো বাপারটা না বুঝেই মান্নাকে ছিন্তাইকারি সন্দেহে ধাওয়া করে। খুকিও তাদের সাথে কিছুদূর দৌড়ে গিয়েই মান্নার গনধোলাইয়ের করুণ দৃশ্য দেখে থমকে যায়। আশেপাশের পথচারিরাও অল্প কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটা দূরে ময়লার ঢিবিড় পাশে মুত্র্যবিসর্জন করতে থাকা টোকাই বুলেট একরকম ভাবলেশহীন মনজোগী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে। কিন্তু আর সবার থেকে তার দৃষ্টি আলাদা। সে লক্ষ করছে রুটি আর কলাটা মাটিতেই লুটোপুটি খাচ্ছে। মুত্র্যবিসর্জন শেষ করে আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে রুটিটা নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে সে। হতবাক খুকি পাথরের মত দাঁড়িয়েই থাকে। গনধোলাইয়ের পালা শেষ করে যুবকগুলো নির্বিকার চিত্তে যার যার মত চলে যায়। ব্যথায় কাতরানো মান্নার আশপাশটা ফাঁকা হয়ে আসলে গলির ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে বুলেট। মান্নার ঝুলিটা আগিয়ে দিয়ে পরম বন্ধুর মত গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে থাকে সেমান্নাও যানে এটা তাদের নিত্তদিনের ব্যাপার। চারিদিকে তাকিয়ে তার পেটের দায়ে চুরি করা রুটি আর কলা না পেয়ে এটাও বুঝতে তার দেরি হয়না যে ওগুলো কার পেটে গেছে। অনর্থক ঝগড়ায় না জরিয়ে, রাস্তায় টিকে থাকার যুদ্ধে প্রয়োজনীয় বন্ধুত্বের কথা মাথায় রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বুলেটকে নিয়েই আবার হাটা দেয় নিরুপায় মান্না। অদূরে নিথর দর্শক খুকির চোখ বেয়ে শুধু নি:শব্দে সরু রেখায় অশ্রু বয়ে যায়। এতগুলো নাটোকীওতায় ভারাক্রান্ত নিষ্পাপ খুকি অবশেষে মার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। চোখ ভরা জল নিয়ে মার উদবিগ্নতার বহির্প্রকাশ শুনতে শুনতে কুড়িয়ে পাওয়া খেলনা দিয়ে আবার খেলতে থাকে সে।

Comments